তাফসীরে কুরআন ৪০

সূরা আলে ইমরান : আয়াত নং- ১০১-১১০ (কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান থেকে)


সূরা আলে ইমরান : আয়াত নং- ১০১-১১০
(কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান থেকে)

আয়াত নং- ১০১

________

অনুবাদ:

১০১ঃ এবং তোমরা কিভাবে কুফর করবে? অথচ তোমাদের উপর আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করা হচ্ছে এবং তোমাদের মধ্যে তাঁর রসূল তাশরীফ এনেছেন। আর যে আল্লাহর আশ্রয় নিয়েছে, তবে নিশ্চয় তাকে সোজা রাস্তা দেখানো হয়েছে।


আয়াত নং- ১০২

________

অনুবাদ:

১০২ঃ হে ঈমানদাররা! আল্লাহ্কে ভয় করো যেমনিভাবে তাঁকে ভয় করা অপরিহার্য এবং কখনো মৃত্যুবরণ করোনা, কিন্তু মুসলমান (হয়ে)।


আয়াত নং- ১০৩

________

অনুবাদ:

১০৩ঃ এবং আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো (১৮৬) সবাই মিলে। আর পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়োনা (১৮৭) এবং নিজেদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করো-যখন তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ছিলো, তিনি তোমাদের অন্তরগুলোতে সম্প্রীতি সৃষ্টি করে দিয়েছেন। সুতরাং তাঁর অনুগ্রহক্রমে, তোমরা পরস্পর ভ্রাতৃত্ব-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছো (১৮৮) এবং তোমরা দোযখের একটা গর্তের প্রান্তে ছিলে (১৮৯)। তখন তিনি তোমাদের তা থেকে রক্ষা করেছেন (১৯০)। আল্লাহ্ এভাবেই স্বীয় নিদর্শনাদি বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা হিদায়াত পাও।

________ 

টীকা-১৮৬ঃ حَبۡلُ اللّٰہِ (আল্লাহর রজ্জু)। এর ব্যাখ্যায় তাফসীরকারকদের কতিপয় অভিমত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, “তা দ্বারা ‘ক্বুরআন মাজীদ’ বুঝানো হয়েছে।” মুসলিম শরীফের হাদীস শরীফে বর্ণিত হয় যে, ক্বুরআন পাকই ‘আল্লাহর রজ্জু’ (حَبۡلُ اللّٰہِ )। যে ব্যক্তি এর অনুসরণ করেছে সে হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত; যে ব্যক্তি তা ছেড়ে দিয়েছে সে পথভ্রষ্টতার উপরই। 

হযরত ইবনে মাস্উদ (رَضِيَ اللّٰهُ  تَعَالٰی عَنۡهُ) বলেন, “আল্লাহর রজ্জু দ্বারা ‘জামা‘আত’ (আহলে সুন্নাত) বুঝায়।” তিনি আরো বলেছেন, “তোমরা জামা‘আ!ত (আহলে সুন্নাতের উপর ঐক্যবদ্ধ থাকা) কেই অনিবার্য করে নাও। কারণ, সেটাই হচ্ছে ‘আল্লাহর রজ্জু’, যাকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।”


টীকা-১৮৭ঃ যেমন, ইহুদী এবং খৃষ্টান সম্প্রদায়দ্বয় বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে। এ আয়াতে ঐ কার্যকলাপ ও তৎপরতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যেগুলো মুসলমানদের মধ্যে পরস্পর বিছিন্নতার কারণ হয়। মুসলমানদের সঠিক পথ হচ্ছে- “মায্হাব-ই-আহলে সুন্নাত’। এটা ব্যতীত অন্য কোন পন্থা (মতবাদ অবলম্বন করা ধর্মের মধ্যে দলাদলির নামান্তর এবং তা নিষিদ্ধ।


টীকা-১৮৮ঃ এবং ইসলামের বদৌলতে শত্রুতা দূরীভূত হয়ে পরস্পরের মধ্যে দ্বীনী মুহাব্বাত সৃষ্টি হয়েছে। এমন কি, ‘আউস’ ও ‘খাযরাজ’ গোত্রদ্বয়ের সেই প্রসিদ্ধ যুদ্ধ, যা দীর্ঘ একশ বছর ধরে অব্যাহত ছিলো এবং যার কারণে দিনরাত হত্যা ও লুটতরাজের নৈরাজ্য কায়েম হয়েছিলো। বিশ্বকুল সরদার হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর মাধ্যমে আল্লাহ্ تَعَالٰی তা মিটিয়ে দিয়েছেন, যুদ্ধের আগুন নিভিয়ে দিয়েছেন এবং যুদ্ধবাজ গোত্রদ্বয়ের মধ্যে পারস্পারিক সম্প্রীতি ও ভালবাসার প্রেরণা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। 

টীকা-১৮৯ঃ অর্থাৎ ‘কুফরের অবস্থায়’। অর্থাৎ যদি এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতো, তবে দোযখেই পৌঁছে যেতো। 

টীকা-১৯০ঃ ঈমানের মহামুল্যবান সম্পদ দান করে।


আয়াত নং- ১০৪

________

অনুবাদ:

১০৪ঃ এবং তোমাদের মধ্যে একটা দল এমন হওয়া উচিৎ, যারা কল্যাণের প্রতি আহ্বান জানাবে, ভাল কাজের নির্দেশ দেবে এবং মন্দ থেকে নিষেধ করবে (১৯১)। আর এরাই লক্ষ্যস্থলে পৌঁছেছে (১৯২)।

________ 

টীকা-১৯১ঃ এ আয়াত থেকে সৎকর্মের নির্দেশ প্রদান এবং অসৎ কর্ম থেকে বাধা প্রদান ‘ফরয হওয়া’ এবং ‘ইজমা’ (ইমামদের ঐক্যমত) ‘দলীল’ হওয়ার পক্ষে প্রমাণ গ্রহণ করা হয়। 

টীকা-১৯২ঃ হযরত আ’লী মুর্তাদা (رَضِيَ اللّٰهُ  تَعَالٰی عَنۡهُ) বলেছেন, “সৎ কাজের নির্দেশ দেয়া এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখা শ্রেষ্ঠতম জিহাদ।’


আয়াত নং- ১০৫

________

অনুবাদ:

১০৫ঃ এবং তাদের মতো হয়োনা, যারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং যাদের মধ্যে মতবিরোধ হয়েছে (১৯৩), এরপর যে, সুস্পষ্ট নিদর্শনাদি তাদের নিকট এসেছিলো (১৯৪)। আর তাদের জন্য কঠিন শাস্তি অবধারিত।

________ 

টীকা-১৯৩ঃ যেমন ইহুদী ও খৃষ্টানরা পরস্পর বিছিন্ন হয়ে গেছে এবং তাদের মধ্যে একে অপরের প্রতি অবাধ্যতা ও শত্রুতা প্রবল হয়ে উঠেছে। অথবা, যেমন তোমরা নিজেরাই প্রাক ইসলামী অন্ধকার যুগে পরস্পর বিচ্ছিন্ন ছিলে, তোমাদের মধ্যে হিংসা বিদ্বেষ ও শত্রুতা ছিলো। 

মাসআলাঃ এ আয়াতের মধ্যে মুসলমানদেরকে ঐক্য ও সংহতির নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং মতবিরোধ ও এর কারণ সৃষ্টি করতে নিষেধ করা হয়েছে। হাদীসসমূহেও এর উপর খুব তাকীদ দেয়া হয়েছে এবং মুসলমানদের জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। যখনই 

ফিরকা সৃষ্টি হয়, এ নির্দেশের বিরোধিতার ফলেই সৃষ্টি হয়। আর তারা মুসলমানদের মধ্যে দলাদলি সৃষ্টির অপরাধে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয় এবং হাদীস শরীফের ঘোষণা অনুযায়ী তারা শয়তানের শিকারে পরিগত হয়। (আল্লাহ্ আমাদেরকে তা থেকে আশ্রয় দান করুন।) 

টীকা-১৯৪ঃ এবং সত্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো।


আয়াত নং- ১০৬

________

অনুবাদ:

১০৬ঃ যেদিন কিছু চেহারা উজ্জ্বল হবে এবং কিছু মুখ কালো হবে। কাজেই, যাদের মুখ কালো হয়েছে (১৯৫), ‘তোমরা কি ঈমান এনে কাফির হয়ে গেলে (১৯৬)?’ সুতরাং এখন আযাবের স্বাদগ্রহণ করো স্বীয় কুফরের বিনিময় স্বরূপ।

________ 

টীকা-১৯৫ঃ অর্থাৎ কাফিররা। তাদেরকে ধিক্কার স্বরূপ বলা হবে। 

টীকা-১৯৬ঃ এটা দ্বারা হয়ত সমস্ত কাফিরকে সম্বোধন করা হয়েছে। এতদভিত্তিতে, আয়াতে উল্লেখিত ‘ঈমান’ দ্বারা অঙ্গীকার দিবসের (روز میثاق) ‘ঈমানের’ কথা বুঝায়, যখন আল্লাহ্ تَعَالٰی তাদেরকে বলেছিলেন, “আমি কি তোমাদের রব (প্রতিপালক) নই?” সবাই বলেছিলো, “কেন নন।” (অবশ্যই, আপনি আমাদের রব) আর ঈমান এনেছিলো। এখন যারা পৃথিবীতে কাফির হয়েছে, তাদের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে- “তোমরা ‘অঙ্গীকার-দিবসে’ ঈমান আনার পর (এখন) কাফির হয়ে গেছো।” 

হাসান (رَضِيَ اللّٰهُ  تَعَالٰی عَنۡهُ) এর অভিমত হচ্ছে এতে মুনাফিক্বদের সম্বোধন করা হয়েছে, যারা মৌখিকভাবে স্বীয় ঈমান প্রকাশ করেছিলো, অথচ তারা আন্তরিকভাবে তা অস্বীকার করতো। 

হযরত ইকরামা (رَضِيَ اللّٰهُ  تَعَالٰی عَنۡهُ) বলেছেন যে, তারা হচ্ছে- ‘আহলে কিতাব’ (ইহুদী ও খৃষ্টান); যারা বিশ্বকুল সরদার (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর নবূয়্যাত প্রকাশের পূর্বে হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর উপর ঈমান এনেছিলো। কিন্তু হুযূর (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) এর নবূয়্যাত প্রকাশের পর অস্বীকার করে কাফির হয়ে গেছে। অন্য এক অভিমত হচ্ছে- এটা দ্বারা ধর্মত্যাগীরাই সম্বোধিত, যারা ইসলাম গ্রহণ করে পুনরায় তা থেকে ফিরে গিয়েছিলো এবং কাফির হয়ে গিয়েছিলো।


আয়াত নং- ১০৭

________

অনুবাদ:

১০৭ঃ আর যাদের চেহারা উজ্জ্বল হয়েছে (১৯৭) তারা আল্লাহর অনুগ্রহের মধ্যে রয়েছে। তারা তাতে স্থায়ীভাবে থাকবে।

________ 

টীকা-১৯৭ঃ অর্থাৎ ঈমানদাররা। সেদিন আল্লাহর অনুগ্রহক্রমে তাঁরা আনন্দিত ও উৎফুল্ল হবেন এবং তাঁদের চেহারা উজ্জ্বল ও চমকিত হবে। ডানে, বামে এবং সম্মূখে নূর হবে।


আয়াত নং- ১০৮

________

অনুবাদ:

১০৮ঃ এগুলো হচ্ছে আল্লাহর নিদর্শন, যেগুলো আমি (আল্লাহ্) সঠিকভাবে তোমাদের নিকট পাঠ করছি এবং আল্লাহ্ বিশ্ববাসীর উপর যুলুম চাননা (১৯৮)

________ 

টীকা-১৯৮ঃ এবং কাউকেও বিনা দোষে শাস্তি দেয়া হবে না এবং কারো সৎকর্মের সাওয়াব হ্রাস করেন না।


আয়াত নং- ১০৯

________

অনুবাদ:

১০৯ঃ আল্লাহরই, যা কিছু আসমানসমূহে বিদ্যমান এবং যা কিছু যমীনে রয়েছে। আর আল্লাহরই প্রতি সব কাজের প্রত্যাবর্তন (অনিবার্য)।


আয়াত নং- ১১০

________

অনুবাদ:

১১০ঃ তোমরা শ্রেষ্ঠতম (১৯৯) ঐসব উম্মতের মধ্যে, যাদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে মানব জাতির মধ্যে; সৎকাজের নির্দেশ দিচ্ছো এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করছো, আর আল্লাহর উপর ঈমান রাখছো এবং যদি কিতাবী (সম্প্রদায়) ঈমান আনতো (২০০) তবে এটা তাদের জন্য কল্যাণকর ছিলো। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মুসলমান রয়েছে (২০১) এবং অধিকাংশ কাফির।

________ 

টীকা-১৯৯ঃ হে উম্মতে মুহাম্মাদী! (صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم) 

শানে নুযূলঃ ইহুদী সম্প্রদায় থেকে মালিক ইবনে সায়ফ এবং ওয়াহাব ইবনে ইয়াহুদা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رَضِيَ اللّٰهُ  تَعَالٰی عَنۡهُ) প্রমূখ সাহাবীদেরকে বললো, “আমরা তোমাদের চেয়ে উত্তম এবং আমাদের ধর্ম তোমাদের ঐ ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, যার প্রতি তোমরা আমাদেরকে আহ্বান করছো।” এর খন্ডনে এই আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে। 

তিরমিযী শরীফের হাদীসে হুযূর صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم" ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ্ تَعَالٰی আমার উম্মতকে গোমরাহীর উপর ঐক্যবদ্ধ করবেন না এবং আল্লাহ্ تَعَالٰی এর ‘রহমতের হাত’ জামা‘আত (আহলে সুন্নাত) এর উপর থাকবে। যে ব্যক্তি ‘জামা‘আত’ হতে পৃথক হয় সে দোযখে প্রবেশ করবে।’ 

টীকা-২০০ঃ নবীকুল সরদার মুহাম্মাদ صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর উপর। 

টীকা-২০১ঃ যেমন হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে সালাম এবং তাঁরই ইহুদী সাথীগণ ইহুদী সম্প্রদায় থেকে, আর নাজ্জাশী ও তাঁর সঙ্গীগণ খৃষ্টান সম্প্রদায় থেকে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ